info@desherkhabor24.com

+8801821554477

জীবনযুদ্ধে অনবদ্য বাগেরহাটের জরিনা বেগম

image for জীবনযুদ্ধে অনবদ্য বাগেরহাটের জরিনা বেগম

বাগেরহাট প্রতিনিধিঃ
পঞ্চাশোর্ধ্ব জরিনা বেগম, বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুরের রহিমাবাদ গ্রামে এক চিলতে ঘরে বাস তার। ছোট বেলা থেকেই সংগ্রাম তার জীবনসঙ্গী। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা, মাঠে কাজ করা, বাঁধার মধ্যে পড়তে না পারা, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াআ, স্বামীর নির্যাতনসহ জীবনের প্রতিটি পরদে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে তাকে। তবে হাল ছাড়েননি কখনো।  

সপ্তাহ খানেক আগে এই প্রতিবেদকের কথা হয় জরিনা বেগমের সাথে। জরিনা বেগমের জন্ম হয়েছিলো বাগেরহাটের চিতলমারি উপজেলার পাটরপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র  কৃষক পরিবারে।তার পিতার নাম শাহেন তালুকদার ও মাতার আছিয়া বেগম।১২ ভাইবোনের সংসারে অভাব-ই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। যখন অন্য শিশুরা স্কুলে যেত, তখন তিনি বাবার সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজ করতেন। অন্যের জমিতে ধান কুড়ানো, নদীতে মাছ ধরা, মাঠের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করা—এসবই ছিল তার দৈনন্দিন কাজ।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় ছোটন শেখ এর সাথে তিনি পেশায় একজন মাহিন্দ্রা চালক। কিন্তু বিয়েতেও সুখের দেখা পাননি জরিনা। বিয়ের কয়েক মাস পরই স্বামীর আসল চেহারা প্রকাশ পায়। তিনি ছিলেন মাদকাসক্ত। দিনরাত অত্যাচার করতেন, এমনকি গাছের সঙ্গে বেঁধেও নির্যাতন চালাতেন। শিশু সন্তানদের সামনে অসহ্য নির্যাতন সহ্য করেও জরিনা সংসার ছাড়েননি, বাবার বাড়িতেও ফিরে যাননি। তিন সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে চলে যান  ঢাকায়। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ নেন। সন্তানেরা ছোট থাকায় তাদের বাসায় আটকে রেখে কাজে যেতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়ে যান। বড় মেয়ে একটু বড় হলে সেও কাজে যোগ দেয়। সুন্দর ভাবে জীবন চলতে থাকে। কিছু টাকাও জমা রাখেন। কয়েক বছর পর স্বামী অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসেন জরিনার কাছে। অতীতের সব ভুল ভুলে তিনি তাকে গ্রহণ করেন এবং সন্তানদের নিয়ে গ্রামে ফেরেন। কিন্তু ফিরে আসার কিছুদিন পরই স্বামীর ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য তার কাছে যা জমানো টাকা ছিল  সবই খরচ করেন, সন্তানদের ঢাকায় পাঠিয়ে উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। যখনই সুখের দেখা পাবেন তখন দুঃখের ছোঁয়া এসে পড়ে। ২০২২ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসার চালানো নিয়ে খুব দুঃচিন্তায় পরেন জরিনা বেগম। কিন্তু তখন ও তিনি মনোবল হারায়নি। তার ছোট বেলা থেকেই জেদ ছিল সবাই যা পারে আমি কেন পারবো না। এরপর মানুষের  বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে চলে সংসার। মানুষের বাড়িঘরে, মাঠে, রাস্তায় কাজ করের তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে ফের শুরু হয় তার বেঁচে থাকার লড়াই।

এমন কঠিন সময়ে ২০২৪ সালে একটি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম মাধ্যমে গরু কিনে দেয় তাকে। সেখান থেকেই শুরু হয় তার নতুন স্বপ্নের পথচলা।
 শুরু করেন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন ও বিভিন্ন সবজি চাষ। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে তার জীবনযুদ্ধের চাকা। করেছেন ভাগ্য পরিবর্তন। কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজের ভাগ্য বদলেছেন তিনি।

 
জরিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী যখন মারা যায় তখন আমার মনে হলো আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়লো। আসলে আমার স্বামী আমাকে নির্যাতন করতো তার পর ও সে আমার স্বামী। আমার স্বামী প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই উপর আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন ‌। আমার আর আমার মেয়ের জমানো কিছু টাকা সব আমার স্বামীর চিকিৎসা বাবদ খরচ করি। স্বামী  মারা যাওয়ার পর খুব অভাব-অনটন ছিল সংসারে। কিভাবে সংসার চালাব ও ছেলে-মেয়েদের মানুষ করব— এই নিয়ে খুব চিন্তা হতো। কি করব, না করব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই সময় পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়নি। বরং কেউ সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেই নাই আমাকে । নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে এবং কারও কাছে যেন সাহায্যের হাত পাততে না হয়, সে জন্য পরিশ্রম করে এখন এ পর্যায়ে এসেছি।


একটা সময় যিনি অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতেন, আজ তিনি গবাদি পশুর খামার করে স্বাবলম্বী। শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের ভবিষ্যৎও গড়ে তুলেছেন নতুনভাবে। তার এই সাফল্য দেখে স্থানীয়রাও এখন খুশি। 

জরিনা বেগমের মেয়ে সুলতানা বলেন, আমার মায়ের মতো এমন অসহায় মা  আমি দেখি নাই। আমার বাবা আমার মাকে অনেক নির্যাতন করতেন গাছের সাথে বেঁধেও পিটিয়েছেন তারপরও মা আমাদের ছেড়ে যায়নি। আসলে মা এমন ই হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ দোলোয়ার বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করেছেন জরিনা মাঠে-ঘাটে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গরু পালন করছেন। আমাদের তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হই।  


ব্র্যাক আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের সংগঠক পূর্ণিমা পাল বলেন, আমি এই দুঃখি মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পেরে আমি খুশি। আমাদের প্রতি টা মানুষের উচিত জরিনা বেগমের মতো ভেঙ্গে না পড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

যাত্রা পুর শাখার ব্র্যাক আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা খাতুন বলেন, আমাদের এই শাখায় ১৯০ জন এই জরিনা বেগম এর মত পরিবার রয়েছে। আমরা তাদের সাবলম্বী করে তোলার জন্য গবাদি প্রাণী পালনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়,গোয়াল ঘর করার জন্য টিন ,ষাঁড় গরু, গরুর কৃমিনাশক, রুচি বর্ধক, ভিটামিন ডিবি পাউডার, ডিসিবি পাউডার ও ৫ টি মারাত্মক রোগের ভ্যাকসিন,ঘূর্ণিঝড় ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হইলে তাৎক্ষনিক ভাবে 2000 টাকা খাদ্য সহায়তা ,ঘর মেরামতের জন্য ৬০০০ টাকার টিন,ক্লাইমেট এ্যডাপটেশন এর জন্য গোয়াল ঘরের মেঝে পাকা করতে, বালু খোয়া ও সিমেন্ট পায়,লবণাক্ত জায়গায় সবজি চাষের জন্য বস্তা, সবজির চারা, নেট পায়,গোখাদ্যের জন্য ৪০০ টাকা ,ঘাস চাষের জন্য ঘাসের বীজসহ বিভিন্ন সহযোগীতা করা হয়।

বাগেরহাট  শাখার ব্র্যাকের রিজওনাল ম্যানেজার মারুফা খাতুন বলেন, জীবনের প্রতিটি বাধা অতিক্রম করে যে মানুষ নিজের ভাগ্য বদলাতে ।বর্তমানে বাগেরহাটের নয়টি উপজেলায় আমরা কাজ করছি।