মাহবুব পিয়াল,ফরিদপুরঃ
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা উপজেলার নিহত ৭জনের মরদেহ শনিবার দিবাগত রাতেই দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে শনিবার বেলা ১১টার দিকে ভাঙ্গা উপজেলার মালিগ্রাম এলাকায় ভাঙ্গা-ঢাকা এক্সপ্রেস ওয়েতে এ দুর্ঘটনাস্থলেই তারা মারা যায়। তবে অ্যাম্বুলেন্স চালক মিতুল মালোকে (২৪) মারাত্মক আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। ফরিদপুর জেলা প্রশাসন শনিবার রাতেই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) বিপুল চন্দ্র দাসকে প্রধান করে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। গতকাল রবিবার দুপুরে তদন্ত কমিটি ৮জন নিহতের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ ঘটনায় শিবচর হাইওয়ে থানায় প্রাথমিকভাবে একটি জিডি করা হয়েছে।
জানা যায়, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফেলানননগর উত্তরপাড়া গ্রামের সৌদি প্রবাসী মো. আজিজার শেখের স্ত্রী তাসলিমা বেগম (৫০) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়ে মেঝ মেয়ে বিউটি বেগমের বাসায় অবস্থান করছিলেন। নিহত তাসলিমা বেগমের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে আসন্ন ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে ঢাকার কদমতলী এলাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ফেলান নগরের উদ্দেশ্যে তার দুই মেয়ে, চার নাতি-নাতনীসহ ৭ জন সকাল ৯টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকা থেকে রওনা দেন। পথিমধ্যে বেলা ১১টার দিকে ভাঙ্গার মালিগ্রাম ফ্লাইওভারের অ্যাপ্রোস সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে গাড়িতে আগুন ধরে যায়। মূহুর্তের মধ্যে দাউদাউ করে গাড়িতে জ্বলা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাদের দেহ। এ সময় ভাঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে আহত চালক মিতুল মালোকে (২৪) উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাতে পারলেও অ্যাম্বুলেন্সে থাকা সাতজন দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে ঘটলাস্থলে ছুটে যান ফরিদপুরের ডিসি কামরুল আহসান তালুকদার এবং পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান। নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে সনাক্তের জন্য ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। নিহতদের ব্যাগে থাকা কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জেলা প্রশাসন জানতে পারেন নিহতদের বাড়ি বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের ফেলাননগর গ্রামে। ডিসি-এসপি বোয়ালমারীর ইউএনও এবং ওসিকে বিষয়টি জানান। পরবর্তীতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের সহায়তায় নিহত তাসলিমা বেগমের বাড়িতে দুপুর ৩টার দিকে এ খবর পৌচ্ছালে স্বজনদের কান্নায় ভারী হতে থাকে ফেলাননগর গ্রাম। শনিবার রাত ৯টায় জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে নিহত তাসলিমা বেগমের মরদেহ ফেলাননগর, তার বড় মেয়ে শেখর ইউনিয়নের মাইটকুমড়া গ্রামের আলমগীর খানের স্ত্রী কমলা পারভীন (৩২), কমলা পারভীনের বড় ছেলে আরিফ (১৩), মেঝ ছেলে হাসিব (৮) ও কন্যা আফসার (২) লাশ রাত ১০টায় মাইটকুমরা গ্রামে এবং তাসলিমার মেঝ মেয়ে পাশ্ববর্তী উপজেলা আলফাডাঙ্গার গোপালপুর ইউনিয়নের কুচিয়াগ্রামের সেনা সদস্য মাহামুদুল হাসান রনির স্ত্রী মোসা. বিউটি পারভীন (২৭), বিউটি পারভীনের ছেলে মেহেদীর (১০) মরদেহ নিজবাড়ি কুচিয়াগ্রামে পৌচ্ছায়। নিহতদের লাশ ফেলাননগর-রেনিনগর কবরস্থান, মাইটকুমরা পারিবারিক কবরস্থান এবং আলফাডাঙ্গা উপজেলার কুচিয়াগ্রামে রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নিহতদের প্রত্যেককে জেলা প্রশাসন ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। নিহতদের লাশ স্বস্ব এলাকায় দাফনের বিষয়টি বোয়ালমারীর ইউএনও মোশারেফ হোসাইন ও ওসি মুহাম্মদ আব্দুল ওহাব নিশ্চিত করেছেন।
এ ঘটনায় শনিবার রাতেই জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) বিপুল চন্দ্র দাসকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ ঘটনায় শিবপুর হাইওয়ে থানায় প্রাথমিকভাবে একটি জিডি করা হয়েছে। গতকাল রবিবার দুপুরে তদন্ত কমিটি ৮জন নিহতের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সেখানে তারা প্রায় আড়াই ঘন্টা সেখানে অবস্থান করেন।
স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনদের হারিয়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন আলমগীর খান। শোকার্ত ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁর মা সালেহা বেগম। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। সালেহা বেগম বলেন, প্রতিবছর কোরবানির ঈদে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে আসেন আলমগীর খান। বছরের এই সময়টার অপেক্ষায় থাকতেন আলমগীরের মা সালেহা বেগম (৬৮)। এবারও তাঁরা এসেছেন। তবে আলমগীর ছাড়া সবাই লাশ হয়ে এসেছেন। শনিবার এক সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে আলমগীরের স্ত্রী ও তাঁর তিন সন্তানকে। ঘটনার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে সালেহা বেগমের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। নিহত কমলা বেগম ও তাঁর তিন সন্তান লাশ নসিমনে করে মাইটকুমড়া গ্রামের বাড়িতে আনা হয় ফরিদপুর থেকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁদেরকে দাফন করা হয়। আর তো তাসলিমার বেচে থাকা মেয়ে চায়না (২৫) ও ছেলে আনিস শেখের (১৮) সাথে কথাই বলা যাচ্ছে না। তাদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে এলাকা।
গতকাল রবিবার বিকেলে ফরিদুপর অ্যাম্বলেন্স চালক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সোহেল মিয়া জানান, গাড়ীর ফিটনেসসহ সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। গাড়িটির মালিক রিপন শেখ নিজেই চালাতো। অ্যাম্বলেন্সের ২৪ ঘন্টা সার্ভিস দিতে সেজন্য অপর চালক মিতুল মালো ওইদিন গাড়ি নিয়ে যায়। রিপনের অসুস্থ্য স্ত্রীকে নিয়ে দৌড়ঝাপ করছে এজন্য তার নাম্বারটি বন্ধ রয়েছে। তবে নিহত চালক মিতুল মালোর পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এখনো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি।
এ ব্যাপারে শিবপুর হাইওয়ে থানার ওসি আমিনুল ইসলাম জানান, শনিবার রাতেই সার্জেন্ট জয়ন্ত সরকার বাদি হয়ে ৮জন নিহতের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেছেন।
শনিবার রাতে এ ব্যাপারে বোয়ালমারী থানার ওসি মুহাম্মদ আব্দুল ওহাব বলেন, ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার মাধ্যমে জানতে পারি নিহতরা সকলেই বোয়ালমারীর ফেলাননগর গ্রামের বাসিন্দা। বিকেলেই পুলিশসহ নিহতদের পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে ফরিদপুর হাসপাতালে মৃত দেহ সনাক্ত করা হয়। পুলিশ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিহতদের মরদেহ স্বস্ব এলাকায় পৌঁছালে রাতেই লাশ দাফন সম্পন্ন করা হয়।
গতকাল রবিবার বিকেলে অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৮জন নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান ফরিদপুর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিপুল চন্দ্র দাস জানান, আমরা ছয়জন সদস্য নিহতদের ঘটনাস্থলে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত তদন্ত করেছি। এ ঘটনায় প্রাথমিক ভাবে শিবপুর হাইওয়ে থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। গাড়ীর ফিটনেস, কাগজপত্রের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করলে তিনি জানান, বিআরটিএর ওয়েব সাইটে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অ্যাম্বলেন্সটির ২০২৩ সালের ফিটনেস সনদের মেয়াদ আরো কয়েক মাস রয়েছে। দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কাজ চলছে।